‘মারে, পড়াশোনার ভাগ কাউকে দিতে হবে না। আর কেউ তোমাকে পড়া করেও দিতে পারবে না। তাই নিজের মতো করে পড়াশোনা করো আর মানুষের মতো মানুষ হও’-কথাটি বাবা আমাকে প্রায়ই বলতেন। তিনি পেশায় কৃষক ছিলেন। বাবার পুঁজি বলতে শুধু তার ছেলেমেয়েই এবং এ পুঁজি তাদের পেছনেই বিনিয়োগ করতেন। কিন্তু আশানুরূপ ফল পাননি। তাই তার সর্বশেষ ভরসার জায়গা হলাম আমি। তিনি আমাকে দিয়ে বাকি ছেলেমেয়েদের অসম্পূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছিলেন। আজ তার স্বপ্নটা বাস্তবে রূপ দিতে পারলেও তিনি আমাকে ছেড়ে সেই ১৮ বছর বয়সেই বহুদূর চলে গেছেন। আমার এ বিজয়ের ভাগিদার তিনি হতে পারলেন না।
অনেকটা ভেজা ভেজা কণ্ঠে নিজের স্বপ্ন পূরণের কথা এভাবে ব্যক্ত করছিলেন ১৩তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (সহকারী জজ) পরীক্ষায় অষ্টম মেধাতালিকায় মনোনীত কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফা আক্তার।
আরিফা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। কুষ্টিয়ার মিরপুরের সন্তান আরিফা ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা-দূরন্তপনা সবকিছুতেই তিনি প্রথম স্থানে থাকতেন।
আরিফা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। কুষ্টিয়ার মিরপুরের সন্তান আরিফা ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা-দূরন্তপনা সবকিছুতেই তিনি প্রথম স্থানে থাকতেন।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন পার করেছেন গ্রামের স্কুল থেকেই। শিক্ষকদের প্রতি তার অন্যরকম আকর্ষণ কাজ করত। তাদের সান্নিধ্য পেতে সবসময় উৎসুক থাকতেন, কারণ তারাই তাকে মোটিভেট করতেন। তাই ষষ্ঠ শ্রেণি ব্যতীত তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বরাবরই প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন আরিফা।
অনেকটা আবেগের স্বরে আরিফা আক্তার বললেন, ‘প্রত্যেক নতুন ক্লাসে ওঠার সময় স্কুল পরিবর্তনের জন্য জিদ করতাম কিন্তু আমি বুঝতাম না যে ভালো স্কুলে পড়ানোর সামর্থ্য আমার পরিবারের নেই। আমার ভাইয়েরা বলত ক্লাসে প্রথম হলে স্কুল পরিবর্তন করাবে। আমিও প্রচুর পড়াশোনা করে প্রথম হতাম কিন্তু স্কুল আর পরিবর্তন হতো না। এভাবে প্রথম হতে হতে একসময় স্কুলজীবন শেষ হয়ে গেল।’
২০০৫ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৫০ নিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। স্বপ্ন ছিল মেডিকেলে পড়ে চিকিৎসক হওয়ার। তাই ভালো কলেজে পড়তে হবে। কিন্তু পরিবারের অসচ্ছলতা ও আর্থিক অনটনের কারণে এবারো উপজেলা শহরের মিরপুর মাহমুদ চৌধুরী কলেজে ভর্তি হতে হলো তাকে।
‘কলেজজীবন ছিল আমার সবথেকে কষ্টের। সবসময় ডিপ্রেশন কাজ করত, তাই রেজাল্টও খারাপ হলো। জিপিএ ৩.৮০ নিয়ে আমি এইচএসসিতে উত্তীর্ণ হলাম। এবার মেডিকেলের স্বপ্ন একেবারই ভেস্তে গেল’-যোগ করলেন আরিফা।
প্রথম বছরে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং করতে না পারায় আর পরীক্ষা দেননি আরিফা। দ্বিতীয়বার বন্ধুদের উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। ওই বছরে তিনি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) চান্স পান। ইবিতে ‘ছ’ ইউনিট তথা আইনে ৬১তম মেধাতালিকায় স্থান পান। আইনে চান্স পাওয়ায় আর কোনোদিকে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। জজ হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই ইবিতে ভর্তি হন।
তিনি বলেন, ‘আইনে ভর্তি হলে বাবা সবাইকে বলে বেড়াতেন যে, আমি জজ হবোই এবং তিনি আমাকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। আমিও প্রথম থেকেই জুডিশিয়ারির প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। এরমাঝে আমার জীবনে নেমে আসল বড় বিপর্যয়। জীবনের বড় অনুপ্রেরণাদাতা (বাবা) আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। বাবার মৃত্যুতে আমি মানসিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়ি এবং একা হয়ে যায়।’
‘তখন থেকে আমার আপুই আমাকে দেখাশোনা করেন এবং ভাইয়েরা পরিবারে খরচ জোগান। দ্বিতীয়বার আমার রুমমেট শারমিন নাহার আপু থেকে অনুপ্রাণিত হয় যখন তিনি ১০তম সহকারী জজ পরীক্ষায় মনোনীত হন। তখন থেকেই আমি সিরিয়াস হয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাই। টানা তিনবছর সেশনজটে থেকে এলএলবিতে (স্নাতক) ৩.৪২ এবং এলএলএমে (স্নাতকোত্তর) ৩.৩৩ সিজিপিএ পেয়ে গ্র্যাজুয়েট ও পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করি। বাবার স্বপ্ন পূরণে ২০১৬ সালের জুনে ঢাকায় পাড়ি জমাই। ৩৬ ও ৩৭তম বিসিএসে অংশ নিলেও কোনো রেজাল্ট আসেনি। পরে একমাত্র জুডিশিয়ারির জন্যই পড়ালেখা চালিয়ে যাই এবং জুডিশিয়ারি পরীক্ষার অন্যতম প্ল্যাটফর্ম হক ল’ একাডেমিতে ভর্তি হই।’
‘১০ম বিজেএস পরীক্ষায় নামমাত্র অংশগ্রহণ করি। ১১তম-তে অংশ নিলেও প্রিলিতে ফেল আসে। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। নিজের অবস্থানে অটল থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যাই। অবশেষে ১২তম-তে প্রিলি-রিটেনে পাস করলেও ভাইভা বোর্ডে বাদ পড়ি। তখন মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়। চারটি বছর জীবন থেকে এমনিতেই চলে গেছে। প্রচণ্ড মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে তখন বেকার অবস্থায় দিন অতিবাহিত করছিলাম। এরই মধ্যে ২০১৮ সালে বার কাউন্সিলের সনদ পাই এবং ঢাকা জজকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করি। কিন্তু জজ সাহেবদের সামনে দেখলে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠত। মনে মনে ভাবতাম আমিও তো ওই চেয়ারে বসতে পারি। আরেকবার চেষ্টা করে দেখি। মনে অনেকটা জেদ-সাহস নিয়ে দিনরাত অধ্যবসায় চালিয়ে যাই। অবশেষে বিজয়ের হাসি।’
আবেগাপ্লুত কণ্ঠে কুষ্টিয়ার মেয়ে আরিফা আক্তার বলেন, ‘মহান রবের প্রতি কৃতজ্ঞতা যিনি আমাকে সম্মানিত করেছেন। কৃতজ্ঞতা পোষণ করছি আমার পরিবারের প্রতি, বিশেষ করে আপুর প্রতি। পরিবারের বাইরে শিক্ষকমণ্ডলী, বন্ধু-বান্ধবের প্রতি। বিশেষ কৃতজ্ঞতা পোষণ করছি শারমিন নাহার আপু (সহকারী জজ), নুরুল হক ভাই (হক ল’ একাডেমি) ও শরিফুল ভাইয়ের প্রতি। যারা আমাকে সর্বদা সাহস জুগিয়েছেন। আমি তাদের অবদান কখনো ভুলতে পারব না।’
স্বপ্নজয়ের অনুভূতির কথা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আমি খুব মেধাবী সেটা কখনোই দাবি করি না। আমার মনে হয় যেকোনো প্রাপ্তির পেছনে আল্লাহর সন্তুষ্টি, চেষ্টা ও বাবা-মায়ের দোয়া কাজ করে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে চাকরি এখন মেধার চেয়ে ধৈর্যের ওপর বেশি নির্ভর করে। তাই ধৈর্য ধরে আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে নিজের সর্বোত্তম চেষ্টা চালিয়ে গেলে সফলতা আসবেই।’
‘সমস্যা থাকবেই। এগুলো উপেক্ষা করতে পারলে জীবনযাত্রা সহজ হবে। বাধাবিহীন সফলতার আনন্দ কম তাই বাধাটা থাকাই ভালো। দুঃখগুলোকে পুঁজিতে রূপ দিতে পারলে সুখ আসতে সময় লাগে না’-বলেন সাহস না হারানো এই নারী।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে আরিফা আক্তার বলেন, ‘সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীদের কাছে ন্যায়বিচার পৌঁছে দিতে চাই। সামর্থ্যের মধ্যে নিজ এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়ানো। নিজ গ্রামকে একটি আদর্শ গ্রামে পরিণত করা। সর্বশেষ আমার স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে মেধার ভিত্তিতে বৃত্তি প্রদান করতে চাই।’